আফগানিস্তান এখন স্বাধীন ভূমি
যুক্তরাষ্ট্রের শেষ ফ্লাইট কাবুল ছাড়ার পর আফগানিস্তানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তালেবান। সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান এখন স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র। ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে মার্কিন সেনাদের আফগানিস্তান ছাড়ার ঘটনাকে ঐতিহাসিক মুহ‚র্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাজধানী কাবুলে অবস্থিত হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন তালেবান যোদ্ধারা। এরপরই জয় উদযাপন করতে দেখা গেছে তাদের। আকাশে গুলি ছুড়ে আফগান সদস্যরা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। এর আগে তালেবান দেশের নিয়ন্ত্রণ নিলেও যুক্তরাষ্ট্র কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
কাবুল বিমানবন্দর থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ঘটনায় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছে তালেবান। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, আফগানিস্তানে জাতীয় ঐক্য গড়তে তারা বিন্দুমাত্র চেষ্টা বাকি রাখবেন না। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের এ মুখপাত্র বলেন, আমি আপনাদের মাঝে এ অঙ্গীকার করছি যে, সামাজিক স¤প্রীতি এবং জাতীয় ঐক্য গড়তে বিন্দুমাত্র চেষ্টা বাকি রাখব না। জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন আমাদের অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পুনুরুদ্ধার করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে সকালে কাবুলে হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, ‘আফগানিস্তানকে অভিনন্দন। এ বিজয় আমাদের সবার। আমরা যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো দুনিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। সবার সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।’ মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহারকে ঐতিহাসিক মুহ‚র্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তালেবান বলছে, এর মধ্য দিয়ে মার্কিন দখলদারিত্বের অবসান ঘটেছে। আফগানিস্তান পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সামরিক বিমানটি আফগানিস্তান ত্যাগের পর উদযাপনে মেতে উঠে তালেবান। মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার পরপরই বিমানবন্দরে প্রবেশ করে দলটির যোদ্ধারা। এ সময় সেখানে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে তারা। অনেককে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলতে শোনা যায়। বিমানবন্দরের বাইরেও কাবুলের বিভিন্ন স্থানে তালেবান সদস্যদের বিজয় উদযাপন করতে দেখা গেছে। আতশবাজির ঝলকানিতে আনন্দে উদ্বেল হয় রাজধানীবাসী। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী। একই বছরের নভেম্বরে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় মার্কিন জোট সমর্থিত তালেবান বিরোধী বাহিনী নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট প্রায় বিনা বাধায় মার্কিন সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান।
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের সংবাদদাতা নাবিহ্ বুলোস তালেবানের একদল যোদ্ধার সাথে বিমানবন্দরের সামরিক অংশের একটি হ্যাংগারে ঢুকে পড়েন। তবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক বিমান এবং অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রেখে গেছে তা সবাই বিকল করা হয়েছে। ‘এসব বিমান আর আকাশে উড়বে না’ বলছিলেন আফগানিস্তানে আমেরিকান কমান্ডার জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি। তিনি জানান, কাবুল ত্যাগের আগে ৭৩টি বিমান, ৭০টি সাজোঁয়া গাড়ি এবং ২৭টি হামভি সামরিক যান নষ্ট করেছেন। এসব সামরিক যানের প্রতিটির মূল্য প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার করে। তারা একই সাথে অত্যাধুনিক সি-র্যাম ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ধ্বংস করে গেছে। সোমবার ইসলামিক স্টেটের ছোঁড়া পাঁচটি রকেট এটা দিয়েই ধ্বংস করা হয়েছিল। সব আমেরিকান আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে তা বলা যাবে না। এখনও সে দেশে ১০০ থেকে ২৫০ আমেরিকান রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি। এদের অনেকেই নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে কাবুল বিমানবন্দরের দিকে যেতে পারেননি।
রাতের বেলা তালেবান সৈন্যরা কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়ার পর গতকাল সকালে সেখানে হাজির হন তালেবানের রাজনৈতিক নেতারা। তারা সেখানে মোতায়েন করা তালেবান বাহিনীর প্রতি বক্তব্য রাখেন। বিমানবন্দরের টারম্যাকে দাঁড়িয়ে তালেবানের বিজয় ঘোষণা করেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।
তালেবানের এই নেতা বলেন, এটা শুধু তালেবানের বিজয় না, এটা আফগান জনগণের বিজয়। ভবিষ্যতে কেউ আফগানিস্তান দখল করার চিন্তা করলে তাদেরও এই হাল হবে বলে তিনি হুঁশিয়ার করে দেন।
তালেবানের পক্ষে প্রচার চালায় এমন একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করেন তারিক গাজনিওয়াল। তিনি যে ভিডিও পোস্ট করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ তালেবান যোদ্ধাদের প্রতি আফগান জনগণের সাথে সদয় আচরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। ‘আপনাদের জনগণের সাথে আচরণের প্রশ্নে আমি আপনাদের সতর্ক হতে বলবো। এ দেশ বহু দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছে। আপনাদের ভালবাসা ও সহমর্মিতা তাদের প্রাপ্য। তাই তাদের সাথে কোমল আচরণ করুন। আমরা তাদের সেবক। তাদের ওপর আমরা নিজেদের চাপিয়ে দিতে পারি না’।
কাবুলের বিদ্যালয়ে ফিরতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা : তালেবানরা কাবুলের দখল নেয়ার দুই সপ্তাহ পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়া হয়েছে। সোমবার সেখানে সাদা হিজাব পরিহিত মেয়েসহ আফগান শিশুদের সক্রিয়ভাবে ক্লাসে যোগ দিতে দেখা গেছে।
তালেবানের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক উদ্বেগ রয়ে গেছে এবং হাজার হাজার আফগান এখনও এই দলটি ক্ষমতায় বসার পর দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। তারা দায়িত্ব নেয়ার পরে দুই সপ্তাহ হয়ে গেলেও এখনও এটি স্পষ্ট নয় যে, কোনও সরকারী শিক্ষানীতি আছে কি না বা তালেবানরা স্কুলগুলোর সাথে আলোচনা করেছে কিনা। তালেবানের ভারপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, আফগান মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু তাদের শাসনে ছেলে-মেয়েদের একসাথে ক্লাসে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
তালেবান মুখপাত্র সুহাইল শাহীন চলতি মাসের শুরুর দিকে একটি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, নারীরা ‘প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা পেতে পারে।’ তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় বাধা নেই। তবুও, কাবুলভিত্তিক সূত্রের বরাতে ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র বিক্ষিপ্ত বেসরকারি স্কুলগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। যখন অনিশ্চয়তার আবহাওয়ায় অধিকাংশ মেয়েদের স্কুল বন্ধ রয়েছে।
তালেবানের কাছে ভারতীয় ক‚টনীতিকদের ধরনা : এদিকে আফগানিস্তানে আটকে পড়া নাগরিকদের দ্রæত দেশে ফেরার ব্যবস্থা করতে তালেবানদের কাছে ধরনা দিয়েছেন ভারতের ক‚টনীতিকরা। কাতারের রাজধানীয় দোহায় তারা তালেবানের একজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দোহায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল তালেবান নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দোহায় ভারতের দূতাবাসের ভেতরে এই বৈঠক হয়। এছাড়া আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু নাগরিক যারা ইন্ডিয়ায় ভ্রমণ করতে চায় তাদের বিষয়েও কথা বলেছে ভারত। সূত্র : বিবিসি বাংলা, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ডন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, এএফপি ও আল-জাজিরা।